কক্সবাজারের তৎকালীন শহরতলীর তারাবনিয়াছড়া জামে মসজিদের নিকটেই আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা। গত ৩ দশকে এখন তা শহরের অন্যতম প্রধান প্রাণ কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। ১৫ থেকে ২০ টা পরিবারের একটা মহল্লা এখন কক্সবাজার শহরের সবচেয়ে ব্যস্ততম আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা। আমাদের ছেলেবেলায়, ৮০ দশকের শেষ দিকে, অনেক খোলা জায়গা ছিল, যেখানে মহল্লার সব ছেলে-মেয়ে খেলাধুলা করতাম। ফুটবল, ডাংগুলি, হাডুডু, কানামাছি, মারবেল, এমনকি ঘুড়ি উড়ানো নৈমিত্তিক খেলা ছিল। এখন পুরা এলাকা জুড়ে কংক্রিটের জঙ্গল।
কক্সবাজার বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। এখানে প্রায় ৪০০ শতাধিক হোটেল রয়েছে। যা রাজধানী ঢাকা শহরের চেয়েও বেশী। মাত্র ২ বা ৩ কিলোমিটার জুড়ে এই পরিমাণ স্থাপনা একটা বিরাট বস্তির তৈরী করেছে। সরকারী ছুটির সময়ে কয়েক লাখ পর্যটক কক্সবাজারে ভিড় করে। বেড়াতে আসে?
কি আছে কক্সবাজারে? কেন আসে? কিসের টানে? শুধু সাগরের ঢেউ কিংবা সমুদ্রস্নানে? কক্সবাজারের সাথে সড়ক, রেল ও আকাশ পথে দেশের সব জায়গা থেকে সরাসরি যোগাযোগ আছে। এই যোগাযোগের জন্য এখনও আমাদের কক্সবাজার দেশে ভ্রমনের জন্য মনোপলি উপভোগ করছি। যদিও রেলের টিকিট প্রচুর নয়-ছয় চলমান। যা রুপকথাকেও হার মানিয়েছে। টিকিট ব্যবস্থাকে প্রকৃত ডিজিটাল করা দরকার, খুব দ্রুত। না হলে দিনে দিনে রেল জনপ্রিয়তা হারাবে। বিকল্প স্থান বা ডেসটিনেশনের কারনে এখনও মানুষ কক্সবাজারে আসছে। যদি কুয়াকাটা, সিলেট, খুলনা কিংবা হিল-ট্রাকসে ভাল সুযোগ-সুবিধা হয়, দিনে দিনে এর পরিমান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। কারন এখনও আমরা পর্যটকদের জন্য বিশেষ কোন কিছুর আয়োজন করতে পারি নাই। বিশেষ করে, সন্ধ্যায় তাদের সময় কিভাবে কাটবে বা কি উপভোগ করতে পারে? কক্সবাজারে এখনও কোন কনফারেন্স সেন্টার নাই। এক্সিবিশন সেন্টার নাই। আন্তর্জাতিক মানের তো নয়ই, দেশীয় মানের শপিং সেন্টারও নাই।
কক্সবাজারে আসার সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় হয়রানি। বাস, ট্রেন থেকে নামার পর থেকেই টমটম ওয়ালাদের দৌরাত্ব্য। কখন হোটেলের রুম চেক ইন করতে পারবে। আবার কখন ছাড়তে হবে। কি কি দেখা যায়, কোথায় কোথায় যাওয়া যায়? এর কোনও গাইড নাই। ইনফরমেশন নাই। এই ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগেও তাদের নিজ উদ্যোগে খঁজে বের করতে হয়। আমাদের আছে ডুলাহাজারা সাফারী পার্ক, রামুর বৌদ্ধ বিহার, ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের অফিস – বাসা, নারিকেল বাগান, সম্রাট অশোকের মন্দির, টেকনাফের সীমানার সাথে আছে মাথিনের কুপ, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির সহ বিস্তীর্ণ সমুদ্র সৈকত। শহরে আছে রাবার ড্যাম, সুলতানি আমলের মসজিদ, বৌদ্ধ বিহার, বার্মিজ মার্কেট। আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রিফিউজি ক্যাম্প। নাই নৌবিহারের ব্যবস্থা, সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, জাদুঘর কিংবা ভালো মানের কোনো সিনেমা হল বা উপভোগ্য শপিংমল।
২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, ২৯ লাখ হল কক্সবাজার জেলাবাসী, আবার ১ লাখ ৬৭ হাজার কক্সবাজার শহরবাসী। আর একটানা ৩ দিনের ছুটি পাওয়া গেলেই দেখা যায় এখানে বেড়াতে আসেন প্রায় ৫ লাখ ভ্রমণ পিপাসু! তাহলে বছরে কত মানুষ কক্সবাজার আসেন? ৫ মিলিয়ন থেকে ১৩ মিলিয়ন। ভেবে দেখুন কত বড় বাজার হাতের কাছে!
জেলা প্রশাসনের একটা ‘বিচ ম্যানেজম্যান্ট কমিটি’ আছে। কি করেন তারা? সমুদ্র সৈকতে হাজার খানেক কিট-কট, কয়েকশ ফটোগ্রাফারের পেশার লাইসেন্স, কিছু চটপটি – ফোসকা ওয়ালার দোকান বসানোর সার্টিফিকেট, শামুক – ঝিনুক বেচার দোকানদারের বৈধতা দেয়া ছাড়া কি করেছে? সরকারী দিবস পালন করাই তাঁদের মূখ্য উদ্দেশ্য মনে হয়। আমাদের আঞ্চলিক লোকশিল্পের প্রচার ও প্রসারে এদের কোন ভূমিকা নাই। আগ্রহও নাই।
আপনারা একবার চিন্তা করে দেখেন, একজন পর্যটক হাজার হাজার টাকা খরচ করে কক্সবাজার আসছে। বেড়াতে, স্রেফ বেড়াতে। এটা কোন তীর্থস্থান নয়। দিনের বেলা সমুদ্রের পানি দেখল, ইচ্ছে হলে সমুদ্রস্নান করল। তারপর খিদাপেটে খেতে গেলে, হাতে গোনা কয়েকটা খাবার দোকান সুস্বাদু ও ভালো খাবার বেচে। তাদের কাছে গেলে প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করে খেতে হবে। নতুবা যেমন-তেমন মানের খাবার খেতে হবে। তারপর, সন্ধার পর আপনি কি করবেন? কিছু আছে, দেখার, করার? শপিং-এর নামে চলে শুটকি আর নকল আচার কেনা-বেচা। সারা শহর এখন শুটকির দোকানে সয়লাব। বার্মিজ মার্কেট এখন শুটকি মার্কেট।
পৃথিবীর প্রতিটা জনপ্রিয় শহরে রয়েছে সুভেন্যিরের ব্যবস্থা। থাইল্যান্ড-এর আছে প্যাগোডা, বালিতে বিক্রি করা হয় সার্ফিং-এর রেপ্লিকা সহ রং-বেরঙের কাপড়, মালয়শিয়ার আছে টুইন টাওয়ার, এমনকি নেপালের আছে হিমালয় বা মন-কামনা। আমাদের আছে প্যাগুডা, ইলিশ, রুপচাঁদা, চিংড়ি মাছ, পান, পাহাড়, রয়েল বেঙ্গল টাইগার কিংবা হরিণ। এসব আমরা হাতে বুনে টুরিস্টদের হাতে তুলে দিতে পারতাম। এসব পরিবেশ সম্মত পণ্য তৈরীর সাথে সাথে বিপুল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করতে পারতাম। ঘরে ঘরে। কিন্তু আমরা সেরকম এখনও কিছু করতে পারি নাই। শুধু ১টি করে টি-শার্ট-এর কথা চিন্তা করলেও আমাদের টুরিজম থেকে ইনকাম করা যায।
কক্সবাজারবাসি হিসেবে আমাদের জন্য কি নাগরিক সুবিধা আছে? ?
আমাদের ছেলে বেলায় সমুদ্রের গর্জনে ঘুম ভাংত। তখন দালান – কোটা কম ছিল। ছিল না বললেই চলে। রাস্তা ছোট ছিল। মানুষ বা অধিবাসি কম ছিল। পর্যটকও কম ছিল। সেই একই সাইজের রাস্তা দিয়ে এখন তার চেয়ে কয়েক হাজার গুন বেশি মানুষকে যাতায়াত করতে হয়। তাই সবসময় রাস্তায় শ্লথ গতি।
বাকখালী এবং বঙ্গোপসাগরের অববাহিকায় হওয়ার পরও কক্সবাজারের জলাবধ্যতা এখন নৈমত্তিক বিষয়। কেন? শুধুই কি পানির উচ্চতা বাড়ছে। আমরা কি আমাদের করনীয় করেছি?
জাদি পাহাড়, ঘোনার পাড়া, বৈদ্যঘোনা, খাজা মঞ্জিল, টেকনাইপ্পা পাহাড় – এই পাহাড়গুলো সব শহরের দক্ষিন দিকে অবস্থিত। এখানে রাতারাতি পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করা হল। পাহাড় কাটা মাটি নেমে নালা, ছড়া এবং খাল গুলো ভরাট হল। এই মাটির সাথে যোগ হল আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের বিভিন্ন রকমের প্লাস্টিক পন্য। পানির বোতল, পলিথিন, খাবারের প্যাকেট, ইত্যাদি। এই নালা – ছড়া – খালের সোপান বা প্রবাহ ঠিক রাখার কোন ব্যবস্থা না করে রাস্তা উঁচু করা হল। প্রায় ২২০ কোটি টাকার রাস্তা। প্রায় ৪ বছরের অবর্ননিয় কষ্টের মাধ্যমে পাওয়া রাস্তায় কি পেল কক্সবাজার বাসী। নিজেদের বাড়ী-ঘর নিচু হয়ে গেল। বৃষ্টিতেই পানি এখন নিজেদের বসত ভিটায় ঢুকে পড়ে। রাস্তা আছে আগের মত সাইজে। প্রসস্ত করা হয় নাই। এত মানুষ বাড়ল। লাখ লাখ পর্যটক আসে। ব্যবসা – বাণিজ্য বাড়ল। স্কুল – কলেজ – মাদ্রাসা সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ল। এগুলোকে বিবেচনা করা হল না।
যে রাস্তা আছে, যে নালা আছে – এ গুলোর কোন অভিবাবক নাই। বা নিবার্চিত প্রতিনিধিদের দেখা গেছে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতে। সেবার দিকে না। তাই নিয়মিত এগুলা পরিস্কার রাখার দিকেও কারও নজর নাই। আবার রোহিঙ্গা ইস্যুর কারনে ককসবাজারবাসীকে কয়েকবার প্রমাণ করতে হয় – ‘আমি কক্সবাজারবাসী’ বা কক্সবাজারের নাগরিক। আমার মনে হয় জনপ্রতিনিধিদের বেশিরভাগ সময় এ কাজেই ব্যয় হয়। জন্ম নিবন্ধন, নাগরিক সনদ, পাসপোর্ট এনডোর্স ইত্যাদি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আবর্জনা ব্যবস্থাপনার জন্য ইনসিনিটর বসানো হলেও কক্সবাজার সহ অন্য কোনো পৌরসভায় এরকম কোন ব্যবস্থা নাই। যার কারনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় না এসে দিনে দিনে এটা একটা মারাত্নক আকারে সমস্যার রূপ ধারন করছে। প্রতিটা অলি – গলি, মোড় এখন বর্জ্যতে সয়লাব। যা পরে গিয়ে প্রবাহিত হয় নালায়, ছড়ায়। একারনে নালাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। বৃষ্টিতে পানি প্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত হয়। সম্প্রতি আমরা, ডায়াডিক রিসার্স ইমপ্যাকটস, খুরুস্কুলে স্থাপন করেছি, স্থানীয়ভাবে অর্গানিক বর্জ্য-ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে Black Soldier Fly (BSF) larvae তৈরীর খামার। এই লার্ভা মুরগী এবং মাছের খাদ্যের প্রোটিন এর প্রাকৃতিক উৎস। যেখানে প্রতিদিন ২ টন বর্জ্য প্রসেস করে ৩০০ কেজি লার্ভা প্রডাকশন করা হচ্ছে। আমরা স্থানীয়ভাবে বর্জ্য থেকে মিথেন গ্যাস নিঃসরন কমানোর বা বন্ধ করার চেষ্টা করছি। সাথে সাথে বৈদেশিক মুদ্রা (ডলার) ব্যবহার করে প্রোটিন আমদানিতে বিকল্প হিসেবে দেশের অর্থনীতে সরাসরি অবদান রাখতে পারব যদি এই প্রসেসকে বড় আকারে বা আরও অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া গেলে। এতে আমরা কার্বন নিঃসরনের মাত্রা নিয়ন্ত্রনেও ভূমিকা রাখতে পারব।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাজ বলতে এখন পর্যন্ত যা দেখা গেছে, কিছু সড়ক বাতি, ৬ কিলো রাস্তা নির্মান নামে পুরা শহরবাসীর গলার কাটা তৈরী, কয়েকটা স্থাপনায় অভিযান।
কক্সবাজারে ৬০ মেঘাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎ তৈরী হয়। খুরুস্কুল, চৌফলদন্ডি, পোকখালী এলাকায়। আবার, টেকনাফে আছে ২০ মেঘাওয়াটের সোলার পাওয়ার প্লান্ট। কিন্তু এখানে লোড-শেডিং হয় যখন তখন। মহেশখালীর কুহেলিয়া নদীর তীরে আরও ১৬০ মেঘাওয়াট সোলার এনার্জি প্রডাকশন প্রক্রিয়া চলমান।
প্রায় পৌনে দুই লাখ (?) অধিবাসীসহ অর্ধ সহস্র হোটেল, হাজারের বেশি অফিস–আদালত, লাখ লাখ পর্যটকের পানির চাহিদা মেটানো হয় শুধু ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে। যুগের যুগের পর যুগ। সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর মতে প্রতি বছর কক্সবাজারবাসী ১০ থেকে ১২ ফুট পানির লেয়ার হারাচ্ছে বা পানির লেয়ার আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রায় ১০ বছর আগে শুরু হওয়া বাকখালী খালের পানি শোধনাগারটির কাজ শুরু হলেও এখনো পানি সরবরাহ শুরু করা হয় নাই। নিরাপদ ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে গিয়ে প্রতিটি পরিবারকে খরচ করতে হচ্ছে প্রায় দুই লাখ টাকা। এটাও ক্ষনস্থায়ী। এটার সরাসরি প্রভাব আছে এই জনপদের দারিদ্রতায়। এই অপ্রতিরোধ্য, লাগামহীন পানির যোগান দিতে গিয়ে আমাদের একমাত্র পৃথিবীর অবস্থা কি হচ্ছে? কারও এ বিষয়টা দেখার সময় নাই। শোধনাগারটি অতিদ্রুত সময়ে চালু করা জরুরী।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার, প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য রাস্তা। এবং কক্সবাজার থেকে টেকনাফ প্রায় ৯০ কিলোমিটার – এই জনপদের মানুষের প্রধানতম যোগাযোগ মাধ্যম। এটা এখনও সিংগেল লেন। এই পাহাড়ী আঁকা-বাঁকা পথ পাড়ি দিতে, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার, আমাদের প্রায় ৫ ঘন্টা সময় দিতে হয়। এই রাস্তায় আছে অসংখ্য হাট-বাজার, স্টেশন, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল। গাড়ীর ধীরগতির সাথে সাথে আছে অসংখ্য সড়ক দুঘর্টনা। নিহত হওয়াসহ, আহতদের পরিবারের অবর্ননীয় কষ্ট, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। উপার্জনহীন অবস্থায় চিকিৎসা ব্যয় চালানো অত্যন্ত কষ্টকর। দুর্ঘটনাকবলিত প্রতিটি পরিবার বাধ্য হয় দারিদ্রতাকে বরন করে নিতে। অথচ দেখুন, কর্ণফুলি নদীর উপর ২টা ব্রীজ আছে। ১টি ফেরী আছে। এবং ১টি টানেল। এগুলো দিয়ে পার হওয়া গাড়ী এবং এই রাস্তার দুপাশ জুড়ে জনপদের মানুষের একমাত্র রাস্তা সিংগেল লাইনের। এই রাস্তাকে ২টা সার্ভিস লাইনসহ ৬ লেনে উন্নিত করলে যাতায়াত সময় ও পরিশ্রম উভয়ই লাঘব হত। সাথে সাথে আমাদের কর্ণফুলি নদীর টানলের সাথে সংযোগকারী মেরিন ড্রাইভের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহর থেকে কক্সবাজারে বিকল্প রাস্তাটি দ্রুত শেষ করা দরকার। এই রাস্তা বহুমূখী সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচন করে দিবে। সুযোগ বাড়াবে স্থানীয় কৃষিসহ বিভিন্ন উৎপাদকের। তাদের বাজার বড় করতে পারবে। স্থানীয় কর্মসংস্থানে বিরাট ভূমিকা রাখার সুযোগ পাবে। উৎসাহিত হত সার্কুলার ইকোনমি।
শিক্ষা: ১টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, ১টি মেডিক্যাল কলেজ, ৪টি সরকারি কলেজ, ১টি সরকারী পলিটেকনিক্যাল কলেজ সহ কয়েকটি বেসরকারী টেকনিক্যাল স্কুল, ও প্রায় ১৫০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসা শিক্ষা – বিতরন করছে। এর কতটা কর্মমূখী? জীবনমূখী? আমাদের দরকার বাস্তবমুখি বা কর্মমূখী শিক্ষা, বিশেষ করে, পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্বল্প মেয়াদি শিক্ষা, যেমন, হোটেল ম্যানেজম্যান্টের বিভিন্ন বিষয়, নিরাপদ ও সুস্বাদু খাবার রান্নার কোর্স, টুরিস্ট গাইড, ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্ট ইত্যাদি। ইংরেজি, ফরাসি, আরবি, বার্মিজ সহ বিভিন্ন ভাষা কোর্স। সাথে রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, রঙ-মিস্ত্রি, টাইলস ফিটার, ইলেক্ট্রিশিয়ান, প্লাম্বার, সেনিটারির কাজ সহ বিভিন্ন টেকনিক্যাল কাজ শিখে নিজের দেশে যেমন ভালো মর্যাদাবান ইনকাম করতে পারি তেমনি বিদেশেও দক্ষ জনবল হিসেবে গিয়ে ভালো ইনকাম করতে পারি। আর যদি খেলাধুলার কথা বলি, স্টেডিয়াম ছাড়া, সারা কক্সবাজার শহরে ১ বা ২ টি খেলার মাঠ আছে। যেখানে ছেলে – মেয়ে সবাই খেলতে পারে? পরিবেশ আছে? প্রায় পৌনে ২ লাখ অধিবাসির জন্য এগুলো কি পর্যাপ্ত? একবার চিন্তা করুন। একদা যে শহরকে বলা হত স্বাস্থ্যকর স্থান, সেখানকার মানুষ কি নিদারুনভাবে, অমানুষিকভাবে বেড়ে উঠছে! এরপরও মমিনের মত জাতীয়দলের ক্রিকেটারের জন্ম হয়েছে, মামুন ভাই, মাসুদের মত জাতীয় ফুটবলার পেয়েছি। যদি পর্যাপ্ত সুযোগ থাকত, তাহলে আমাদের আরো অনেক বেশিজনকে জাতীয় পর্যায়ে পাওয়ার সুযোগ থাকত। এই যদি হয় জেলা শহরের অবস্থা, তাহলে পুরা জেলার অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
কর্মসংস্থান – এর কথা আসলে প্রথমে আসবে ‘আমাদের প্রধান পেশা কি’?
কি করে এখানকার মানুষ জীবিকার জন্য? মাছ ধরে, পর্যটন? লবন চাষ? ধান চাষ? গাছ লালন – পালন? চুরি, ডাকাতি? দস্যু? স্থানীয় পাবলো এস্কোবারের (কলাম্বিয়ার কুখ্যাত ড্রাগ লিডার, এককালে পৃথিবী সেরা নগদ টাকার মালিক) ড্রাগ – চালান বাহিনীর সদস্য?
প্রায় পাঁচশত হোটেল থাকলেও লোকাল মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে নাম মাত্র। বিবিধ কারন শোনা যায়। অনেকের দায় – দায়িত্বের কথা শুনা যায়। মোটা দাগে বললে, অশিক্ষিত, অদক্ষ জনগোষ্টি নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেনি। তাই, বেশির ভাগ তরুন বিদেশ-গামী। বিশেষতঃ সৌদি আরব, দুবাই, মালয়শিয়া সহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে অদক্ষ হিসেবে খুবই কম বেতনে কায়িক পরিশ্রম করে। মানবেতর জীবন – যাপন করে। তারা হারায় দেশের মায়া-মমতা ভরা জীবন। জহির রায়হানের ‘সারেং বৌ’-এর মত তাদের পরিবার – পরিজনও থাকে অনিশ্চয়তায়, সামাজিক বিভিন্ন টানাপোড়নে। সাথে সাথে কিছু মানুষ যোগ দেয় পাবলু স্কোবারদের সাথে। সীমান্ত শহরে ড্রাগের চালানের সব সুযোগ তারা নেয়। সীমান্ত রক্ষা বাহিনী ও শান্তি রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের কেউ কেউ জড়িত না থাকলে এই ড্রাগ চোরাচালানি বাহিনীর তৎপরতা কন্ট্রোল করা অসম্ভব ছিল না।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পরে চিকিৎসা ব্যবস্থার সংস্থানের জন্য ২৫০ শয্যার সদর হসপিটালের কিছু আধুনিকায়ন হয়েছে। বিভিন্ন দাতা সংস্থার কারনে। কিন্তু তা এখনও স্থানিয় চাহিদা মেটাতে অত্যন্ত অপ্রতুল। কারন প্রায় ৩০ লাখ মানুষ অধ্যুষিত জেলার প্রধানতম চিকিতসাস্থল এটি। আমরা কি ২৫০ শয্যার হাসপাতালকে ৫০০ শয্যায় উন্নিত করতে পারি না? অথবা বর্তমান শহরের বাইরে, একটু দূরে আরেকটা ৫০০ শয্যার হাসপাতাল করতে পারি না। এই হাসপাতাল আমাদের মেডিকেল টুরিজম করতেও সহযোগিতা করতে পারে। আমাদের এখানে নাই ডায়ালাইসিসের সুবিধা, ক্যান্সার, হৃদরোগ কিংবা স্ট্রোকের মত রোগ হলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা। আবার অন্যদিকে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ব্যয়বহুলও বটে। কিন্তু স্থানীয় জনগন, রিফিউজি এবং পর্যটকদের সুবিধার কথা চিন্তা করে হলেও এ খাতে অগ্রাধিকার পাওয়ার দরকার ছিল। আমাদের ছোটকালে পাঠ্যে ছিল – কক্সবাজার স্বাস্থ্যকর স্থান। কিন্তু এখন বিড়বম্বনার স্থান, যানজটের স্থান। অনিয়মের স্থান। আমরা বলতে পারি – অনিশ্চিত গন্তব্যের স্থান।
পর্যটনকে কেন্দ্র করে আমাদের সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া দরকার যেন এই দরিয়া নগরের মানুষের আতিথেয়তা সবাই উপভোগ করতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট সবাই উপকৃত হতে পারে। পর্যটকদের খরচের একটা বড় অংশ যেন কক্সবাজারবাসী উপার্জন করে নিতে পারে। পর্যটন শিল্পের বিভিন্ন পেশায় এদের সক্রিয় ভূমিকা থাকতে পারে। এজন্য শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা এবং অবকাটামো খাতকে বিশেষ বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা ও দ্রুত বাস্তবায়ন দরকার। এক্ষেত্রে আমাদের স্থানীয় নেতৃত্বের সংকটের বিষয়টাও বিবেচনা করা দরকার। আমাদের এক্ষেত্রে যে যেখানে আছে তারা যদি নিজেদের সম্ভাবনা এবং সুযোগ গুলো দিয়ে দক্ষ জনশক্তি বা নেতৃত্ব দিতে পারে তাহলে একটা আশার কথা বলতে পারি। উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই যদি আমরা সুভেনিরকে শিল্পে পরিনত করতে পারি, ঘরে ঘরে বানানো উৎসাহিত করতে পারি, এবং পর্যটকদের হাতে তুলে দিতে পারি। আমাদের বেকারত্ব সহজেই আরেস্ট করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি আমাদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য তৈরী হতে হবে। সময় খুব বেশী নাই। আবার খুব কমও যে তাও না। প্লান করে এগিয়ে গেলে ৩ থেকে ৪ বছরের মধ্যে এর সুফল পাওয়া সম্ভব।
আমি অসম্ভব আশাবাদি মানুষ। বিশ্বাস করি, সোনালী সূর্য উঠবে, এরপরও স্বর্নালী ভোর হবে। সবার মঙ্গল কামনা করছি। ধন্যবাদ।
এ লেখাটি গত ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ঢাকায় কক্সবাজার কমিউনিটি এলায়েন্স কর্তৃক আয়োজিত প্যানেল ডিসকাশনের জন্য লেখা।
লেখক ‘আ ম ম ফজলুর রাশিদ’ চিফ অপারেটিং অফিসার, ডায়াডিক রিসার্স ইমপ্যাকটস প্রাইভেট লিমিটেড (Dyadic Research Impacts Bangladesh); এই লেখার উপর পাঠকের মতামত আহবান করেছেন। লিখতে পারেনঃ Fazlur.Rashid@yahoo.com
Leave a Reply