ইন্টারনেটের বিবর্তন: গতি ও প্রযুক্তির পথচলা এবং ভবিষ্যৎ

ইন্টারনেটের বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক

ইন্টারনেট বর্তমান বিশ্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। গত কয়েক দশকে এর প্রযুক্তি এবং গতিতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য হওয়া থেকে শুরু করে আজকের অত্যাধুনিক সংযুক্ত (connected) পৃথিবী পর্যন্ত এর যাত্রাপথটি ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

ডায়াল – আপ ইন্টারনেট

১. শুরুর দিনগুলো: ডায়াল-আপ (Dial-Up) যুগ (১৯৯০-এর দশক)

প্রযুক্তি: ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রথম দিকে টেলিফোন লাইন ব্যবহার করে ডায়াল-আপ মডেমের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করা হতো। এসময় ইন্টারনেট ব্যবহার করলে টেলিফোন লাইন ব্যস্ত থাকতো।

গতি: এর গতি ছিল অত্যন্ত ধীর, যা সাধারণত ৫৬ কিলোবিট প্রতি সেকেন্ড (Kbps) এর কাছাকাছি থাকতো।

অভিজ্ঞতা: এই গতিতে একটি সাধারণ ওয়েবসাইট লোড হতে কয়েক মিনিট সময় লাগতো। ছবি বা গান ডাউনলোড করা ছিল এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার ব্যাপার। অনলাইন ভিডিওর কথা তখন কল্পনাও করা যেত না।

ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট

২. ব্রডব্যান্ডের আগমন (২০০০-এর দশক)

প্রযুক্তি: এই দশকে ডিএসএল (DSL) এবং ক্যাবল মডেমের মতো ব্রডব্যান্ড প্রযুক্তি আসে, যা “সর্বদা চালু” (always-on) ইন্টারনেট সংযোগের সুবিধা দেয়। এর ফলে টেলিফোন লাইন মুক্ত থাকে এবং গতিও অনেক বেড়ে যায়।

গতি: ব্রডব্যান্ডের গতি ছিল ডায়াল-আপের চেয়ে বহুগুণ বেশি, যা ১ মেগাবিট প্রতি সেকেন্ড (Mbps) থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে ১০-২০ Mbps পর্যন্ত পৌঁছায়।

অভিজ্ঞতা: ব্রডব্যান্ডের ফলে দ্রুত ওয়েবসাইট ব্রাউজিং, গান ডাউনলোড, এবং ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে নিম্ন মানের ভিডিও দেখা সম্ভব হয়। এটিই ছিল ইন্টারনেটের গণ-ব্যবহারের সূচনা।

৩. ফাইবার অপটিক যুগ (২০১০-এর দশক – বর্তমান)

ফাইবার অপটিক

প্রযুক্তি: ফাইবার অপটিক ক্যাবল, যা আলোর গতিতে ডেটা পাঠাতে সক্ষম, ইন্টারনেট জগতে এক নতুন বিপ্লব নিয়ে আসে। ফাইবার টু দ্য হোম (FTTH) প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারকারীর বাসা পর্যন্ত উচ্চগতির সংযোগ নিশ্চিত করা হয়।

গতি: ফাইবার অপটিকের গতি শত শত Mbps থেকে শুরু করে ১ গিগাবিট প্রতি সেকেন্ড (Gbps) বা তারও বেশি হতে পারে।

অভিজ্ঞতা: এই উচ্চগতির ফলে হাই-ডেফিনিশন (HD) ও 4K ভিডিও স্ট্রিমিং, অনলাইন গেমিং, ক্লাউড কম্পিউটিং, এবং কোনো বাধা ছাড়াই একাধিক ডিভাইস একসাথে ব্যবহার করা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।

মোবাইল ইন্টারনেটের বিবর্তন

তারযুক্ত ইন্টারনেটের পাশাপাশি মোবাইল ইন্টারনেটের বিবর্তনও ছিল চোখে পড়ার মতো।

২জি (2G): এটি ছিল প্রথম ডিজিটাল মোবাইল নেটওয়ার্ক। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল কথা বলা, তবে GPRS/EDGE প্রযুক্তির মাধ্যমে এতে অত্যন্ত ধীর গতির ইন্টারনেট (কয়েকশ Kbps) ব্যবহার করা যেত, যা দিয়ে কেবল সাধারণ টেক্সট-ভিত্তিক ওয়েবসাইট দেখা সম্ভব ছিল।

৩জি (3G): থ্রি-জি মোবাইল ব্রডব্যান্ডের সূচনা করে। এর গতি কয়েক Mbps পর্যন্ত পৌঁছানোর ফলে স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ইমেইল এবং ভিডিও কল করা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

৪জি/এলটিই (4G/LTE): ফোর-জি দ্রুতগতির মোবাইল ইন্টারনেটকে সবার কাছে পৌঁছে দেয়। এর গতি ده‌ها Mbps হওয়ায় মোবাইলে HD ভিডিও স্ট্রিমিং, অনলাইন গেমিং এবং অ্যাপ-ভিত্তিক পরিষেবাগুলোর ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে বাংলাদেশে এটিই সবচেয়ে প্রচলিত প্রযুক্তি।

৫জি (5G): এটি বর্তমান এবং নিকট ভবিষ্যতের প্রযুক্তি। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো:

অকল্পনীয় গতি: মাল্টি-গিগাবিট (multi-Gbps) গতি, যা ৪জি-এর চেয়ে বহুগুণ বেশি।

অতি নিম্ন লেটেন্সি (Ultra-Low Latency): ডেটা প্রেরক থেকে প্রাপকের কাছে পৌঁছাতে প্রায় কোনো সময় না লাগা। এটি চালকবিহীন গাড়ি, রিমোট সার্জারির মতো প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য।

ব্যাপক সংযোগ: একই সাথে লক্ষ লক্ষ ডিভাইস (যেমন: স্মার্ট হোম ডিভাইস, সেন্সর) সংযুক্ত রাখার ক্ষমতা, যা ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT)-কে বাস্তবে রূপ দেবে।

ভবিষ্যৎ

ইন্টারনেটের ভবিষ্যৎ আরও বিস্ময়কর হতে চলেছে।

৬জি (6G): যদিও ৫জি এখনও পুরোপুরিভাবে বিস্তার লাভ করেনি, ৬জি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে গেছে। এর লক্ষ্য হলো প্রতি সেকেন্ডে টেরাবিট (Terabits per second – Tbps) গতি অর্জন করা, লেটেন্সি প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে (AI) নেটওয়ার্কের সাথে আরও নিবিড়ভাবে সংযুক্ত করা।

স্যাটেলাইট ইন্টারনেট: স্টারলিংক (Starlink)-এর মতো প্রকল্পগুলো পৃথিবীর কক্ষপথে হাজার হাজার স্যাটেলাইট স্থাপন করে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও, উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। এটি ভৌগোলিক বাধা দূর করতে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক স্টার্টআপ ‘তারা’ ফাইবার ছাড়াই উচ্চগতির সংযোগ দিতে সক্ষমতার পরীক্ষা চালাচ্ছে। এই প্রযুক্তি স্যাটেলাইট কিংবা ফাইবার ছাড়াই উচ্চগতির সংযোগ দিতে সক্ষম।

কোয়ান্টাম ইন্টারনেট: এটি গবেষণার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নীতি ব্যবহার করে এটি এমন এক সুরক্ষিত যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করবে যা হ্যাক করা কার্যত অসম্ভব হবে।

ডায়াল-আপের ধীরগতির যুগ থেকে শুরু করে আজকের গিগাবিট গতির পৃথিবী এবং আগামী দিনের টেরাবিট ও কোয়ান্টাম যুগের দিকে ইন্টারনেটের যাত্রা সত্যিই অভাবনীয়। ভবিষ্যতে ইন্টারনেট আরও গতিময়, বুদ্ধিমান এবং সর্বব্যাপী হয়ে উঠবে, যা আমাদের জীবনযাত্রা, শিল্প এবং সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে।


Posted

in

,

by

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *